শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ১২:০২ অপরাহ্ন

নতুন বছরে প্রত্যাশার পাশে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ

নতুন বছরে প্রত্যাশার পাশে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ

মুহম্মদ আকবর:

একটা শুরুর শেষ প্রান্ত ধরেই আরেকটা শুরুর আবির্ভাব। নতুন বছরের ক্ষেত্রেও তা-ই। আর নতুন বছর কোনো বিশেষ কিছু নিয়ে মানুষের জন্য অপেক্ষায় থাকে না; বরং একেকটা নতুন বছরই বিশেষ কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। নতুন বছরের জন্য সেই বিশেষ কিছু করার দায় মানুষের। আমজনতার প্রতিনিধি হিসেবে দায় সরকারেরও। তবে জনতার প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সংযোগ ঘটানো যে কোনো সরকারের জন্য সব সময়ই চ্যালেঞ্জের; ২০২২ সালও ব্যতিক্রম নয়।

নানা জঞ্জাল-জটিলতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০২১ সাল। নতুন প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে নতুন বছর। নতুন বছরে দুর্নীতি প্রতিরোধ, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট মোকাবিলা, বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দেশ ও মানুষের কথা বিবেচনায় রেখেই সুন্দর আগামীর লক্ষ্যে দেশ ও দেশের মানুষ এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা বিশিষ্টজনদের। পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, বছরের শুরুতেই রয়েছে সার্চ কমিটি তথা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জটিলতা। ইতোমধ্যে দেশের বেশকিছু রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নিয়েছে। তাদের সবাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে। সামনে আরও কয়েকটি ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তারা ইসি পুনর্গঠনে আইনের প্রস্তাব দেবে বলে জানা গেছে। যদি এ রীতিকে গতানুগতিক এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করে সংলাপে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট। ফলে নানা ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিবেশ ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কাও করছেন এ বিশিষ্টজনেরা।

অন্যদিকে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও কূটনীতিতে প্রভাবশালী দেশের চাপ মোকাবিলার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতা প্রশমন ও তাদের অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা, নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য মানুষের নাগালে আনাও সহজ কাজ হবে না।

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে সারাবিশ্বের মতো দেশেও বহু লোকের কর্মসংস্থান নিয়েও সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহ করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে থাকাটাও সরকারকে ভাবতে হবে। মহামারীর কারণে বিদেশে কর্মরত বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিদেশে সংকুচিত হয়ে আসা চাকরির বাজার সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কাজটিও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের। নইলে সার্বিক রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর বড় ধাক্কা লাগতে পারে। এ ছাড়া প্রবাসী কর্মীদের দেশে ফিরে আসা অব্যাহত থাকলে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে আরও চাপে পড়বে। বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে স্বাস্থ্য খাতও। এ দিকেও নজর দিতে হবে সরকারকে।

তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা সুন্দর আগামীর প্রত্যাশার পাশাপাশি এসব চাপকে স্বাভাবিক বলেই ভাবছেন। রাজনৈতিক দল ও সরকারকে এসব মাথায় নিয়ে পথ চলতে হয়। সুতরাং এ নিয়ে হতাশ না হওয়ার আহ্বান তাদের।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘জঞ্জাল, অসঙ্গতি, অন্ধকার ও প্রতিকূলতা- এসব ভেদ করে মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবে সুন্দর আগামীর দিকে আমাদের হাঁটতে হবে, নতুন বছরে এটাই প্রত্যাশা করি। আর সব সময়ই আমাদের সামনে সংকট আসে। এ বছরও যে আসবে না, তা নয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হয়, এগিয়ে যাচ্ছি।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা হলো, দেশ ও আওয়ামী লীগকে আরও এগিয়ে নেওয়া। নতুন বছরে দল ব্যস্ত থাকবে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর নানা কর্মসূচি নিয়ে। আর সরকার নিয়োজিত থাকবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার মহৎ কর্মে।’

নতুন বছরে সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমাদের সময়কে বলেন, ‘জনগণের যে প্রত্যাশা, তা পূরণে সরকারকে কাজ করতে হবে। যেভাবেই হোক, করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের দেশে যে বঞ্চিত মানুষ আছে, তাদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের সুফল যেন তাদের দোরগড়ায় পৌঁছে, সে ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার সুফল দেশের সব মানুষের ঘরে পৌঁছানো। তাই দেশের যেসব বিত্তবান মানুষ আছে, তারা যদি বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে থেকে কাজ করে, তা হলে সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।’

এদিকে নতুন বছরে বাংলাদেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান।

তিনি বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে চীন বনাম পশ্চিমাদের প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুবই স্পষ্ট। বিশ্ব রাজনীতির যে সমীকরণ, সেখানে বাংলাদেশ বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে।’

নতুন বছরে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে যে আকাক্সক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, যেটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি, সেই আকাক্সক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন চাই, যা এখনো হয়নি। সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। বাংলাদেশের নেতৃত্বে আমলা, সামরিক বাহিনী এবং ব্যবসায়ীদের যে ঝোঁক, সেটা কমিয়ে আনতে হবে।’

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কোভিডের কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে। এটা তো শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অন্য দেশেও একই পরিস্থিতি। কোভিডের আগে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বেশ ভালো করছিল, কিন্তু কোভিডের ধাক্কায় সে অবস্থা আর নেই। এখন মানুষের আয় কমে গেছে। বহু মানুষ বেকার হচ্ছে। আগের বেকার সমস্যা তো রয়েছেই। ফলে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে সরকারকে নানা উদ্যোগ গ্রহণে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘গত তিন দশকে দেশের অগ্রগতি বিশাল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনায় সেখানে বড় রকমের ধাক্কা লেগেছে। দারিদ্র্য বিমোচনও বাংলাদেশের অর্জন। কিন্তু করোনার অভিঘাতে দেশে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ভাঙন তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্ত দরিদ্র হয়েছে, দরিদ্র অতিদরিদ্র হয়েছে। কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। এখন মানুষের টিকে থাকা এবং কর্মসংস্থান তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, আমাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বহিরাঘাত সহ্য করার সক্ষমতা কম।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, কয়েকদিন আগে যুক্তরাজ্যে ডেল্টার একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। সেটিকে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশের অনেক মানুষের ওই দেশটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে; তাই এই সময়ে যারা ব্রিটেন থেকে আসবে, তাদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ ছাড়া ভারতে ইতোমধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। তাই স্থলবন্দরগুলোর ওপরও বিশেষ নজর দিতে হবে, যেন কোনোভাবেই আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এ ছাড়া দেশের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে এবং টিকাদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন বলেও মনে করেন ডা. জাবীন। তিনি বলেন, এসবের পাশাপাশি হাসপাতালগুলোও প্রস্তুত রাখা দরকার। কারণ এই ভ্যারিয়েন্টও বেশ সংক্রমণশীল।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877